শনিবার ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অ্যাগ্রো অর্গানিকার প্রসপেক্টাসে আগা-গোড়া জালিয়াতি: পর্ব-১

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট ২০২৩ | 106 বার পঠিত | প্রিন্ট

অ্যাগ্রো অর্গানিকার প্রসপেক্টাসে আগা-গোড়া জালিয়াতি: পর্ব-১
বিশেষ প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারের এসএমই মার্কেট থেকে কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের জন্য অ্যাগ্রো অর্গানিকা পিএলসি নামক একটি কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
উদ্দেশ্য পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে একদিকে কোম্পানিটি ব্যবসায় সম্প্রসারণ করবে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে মুনাফা ভোগ করবে। কিন্তু তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়াই যদি অস্বচ্ছ কিংবা উদ্দেশ্যই যদি অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়- তবে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে সাধারণ বিনিয়োগ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কতোটুকু লাভবান হবেন, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
কোম্পানির প্রসপেক্টাস বিশ্লেষন ও সরেজমিন তদন্তে কোম্পানিটির তালিকাভুক্তির অসৎ উদ্দেশ্যের যথেষ্ঠ প্রমাণ মিলেছে। কোম্পানিটির প্রসপেক্টাসের আগা-গোড়াই জালিয়াতি আর মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। শুধু তাই নয়, কিউআইওতে অনুমোদন পাওয়ার জন্যে যে ড্রাফট প্রসপেক্টাস বিএসইসিতে জমা দেয়া হয়েছিল- এর সাথে কোম্পানিটির বর্তমান প্রসপেক্টাসে প্রদত্ত তথ্যের রয়েছে ব্যাপক গড়মিল!
এছাড়া সম্পদ বাড়াতে জমির অতিরঞ্জিত মূল্য প্রদর্শন, লিজের জমি নিজের বলে দাবি করা, অন্য কোম্পানির নামে বরাদ্দকৃত জমি নিজের বলে চালিয়ে দেয়া, জমি ক্রয়ের পূর্বেই জমি ব্যবস্থাপনার নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো, অধিকাংশ সময়ে কারখানা বন্ধ থাকা, বাহির থেকে পণ্য কিনে শুধুমাত্র মোড়কজাতকরণের মাধ্যমে নিজেদের প্রোডাক্ট দাবি করা, প্লেসমেন্ট জালিয়াতি এবং বাজারে পণ্য খুজে না পাওয়া অন্যতম।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার খারাপ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে মানসম্পন্ন কোম্পানির অভাব। ভালো কোম্পানি কম, তাই ভালো বিনিয়োগ আসছে না, ভালো বিনিয়োগকারী তৈরি হচ্ছে না।
অ্যাগ্রো অগ্রানিকার মতো আগেও অনেক কোম্পানি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইপিও অনুমোদন নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে বাজার থেকে টাকা তুলে বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছে। যা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
তারা আরও বলেন, ডিসক্লোজারের ভিত্তিতে নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে। অডিটরদের মিথ্যা তথ্য, ইস্যু ম্যানেজারদের প্রতারণা, আন্ডাররাইটারদের জবাবদিহিহীনতা, ইস্যুয়ার কোম্পানির উদ্যোক্তাদের প্রতারণা, কোম্পানির জমির দাম অতিরঞ্জিত করার বিষয়টি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
ভুল তথ্য, মিথ্যা তথ্য, ওভার ভ্যালুয়েশন, ভ্যাট ট্যাক্স পেমেন্ট, রাতারাতি বাজারে আসার আগে কোম্পানির মূলধন ও ইপিএস বেড়ে যাওয়া, পণ্যের বিক্রি বেড়ে যাওয়া, রিজার্ভ বেড়ে যাওয়া, কোম্পানির পণ্যের মজুত বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি যে প্রসপেক্টাস জালিয়াতির প্রধান নিয়ামকে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে বাজার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আইপিও কিংবা কিউআইও অনুমোদনের ব্যাপারে বিএসইসিকে আরও কঠোর হতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কোম্পানিটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে।  ২০১৯ সালের ৩০ জুন কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ২৬ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা। কিন্তু মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির এ মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮ কোটি ৩০ লাখ টাকায়। অর্থ্যাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরেই কোম্পানিটির এ মূলধনের প্রায় পুরোটাই বা ৯৯.৩০ শতাংশ ইস্যু করা হয়েছে। যার প্রায় পুরোটাই শেয়ার মানি ডিপোজিট ও বোনাস শেয়ার থেকে ইস্যু করা হয়েছে।
জানা যায়, ব্যবসায় সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেই অ্যাগ্রো অর্গানিকা শেয়ারবাজার থেকে ৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে।
চাল, আচার, মশলা, ঘি, জেলি, জাফরান ও ইসুপগুল কোম্পানিটির পণ্য তালিকায় রয়েছে। শতভাগ উৎপাদনমুখী এ কোম্পানিটির মোট বিক্রির ৬৫ শতাংশের বেশি আসে চাল বিক্রির মাধ্যমে। আর ২২ শতাংশ কিংবা তার বেশি আসে আচার বিক্রির মাধ্যমে।
বাদ-বাকি ১২-১৩ শতাংশ আসে অন্যান্য পণ্য (মশলা, ঘি, জেলি, জাফরান ও ইসুপগুল) বিক্রির মাধ্যমে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে- যেসব পণ্য ঘিরে কোম্পানিটি চমকপ্রদ মুনাফা করছে, সেসব পণ্য খোলাবাজার, সুপারশপ বা কোন অনলাইন মার্কেটিং প্লেসে খুজে পাওয়া যায় নি। বিশেষ করে কোম্পানিটির ক্রেতা তালিকায় থাকা সুপারশপ স্বপ্ন, অনলাইন গ্রোসারি শপ চালডাল ডটকম এবং দারাজেও কোম্পানিটির কোন ধরণের পণ্যের অস্তিত্ব মেলেনি।
সরেজমিন তদন্তে জানা গেছে, অ্যাগ্রো অর্গানিকার ফ্যাক্টরীতে বাহির থেকে চাল কিনে এনে মোড়কজাত করা হয়। প্রসপেক্টাসে শতভাগ পণ্য উৎপাদনের ঘোষণা দিলেও আচার ছাড়া আর কোন পণ্য উৎপাদন করে না প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন কার্যক্রম। তবে মাঝেমধ্যে অর্ডার পেলে ১০-১২ জন শ্রমিকের সমন্বয়ে এক-দুই দিন কার্যক্রম চলে।
বিসিকের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, কোম্পানিটি মৌসুমী ফলের আচার তৈরী করে। এছাড়া মাঝেমধ্যে বাহির থেকে চাল এনে প্যাকেটজাত করে থাকে। মাত্র দুটি মেশিনের মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালিত হচ্ছে।
এরমধ্যে একটি মেশিনে চাল প্যাকেট করে, অন্যটিতে আচার তৈরী করা হয়। বেশিরভাগ সময়ই এ কারখানাটি বন্ধ থাকে এবং এখানে তেমন কোন শ্রমিক কাজ করে না।
কোম্পানিটির প্রসপেক্টাসের তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, মৌসুমী আচার উৎপাদনকারী এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি ৫ হাজার ৩৪৭ মেট্রিক টন, আর প্রোডাকশন হচ্ছে ৩ হাজার ৭৭৭ মেট্রিক টন।
যা উৎপাদন সক্ষমতার ৭০ শতাংশ। যদিও সরেজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের সাথে প্রকৃত উৎপাদনের এ তথ্যের মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। তবুও উৎপাদন সক্ষমতার ৩০ শতাংশ হাতে থাকার পরও মাত্র ৫ কোটি টাকার জন্য কেন তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এ নিয়েও রয়েছে ব্যাপক গুঞ্জন।
এ বিষয়ে আলাপকালে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সময়ে কোম্পানিগুলোর এমন জালিয়াতি নতুন কিছু নয়। এতে কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের পকেট ভারী হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হচ্ছেন।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএসইসি কি দেখে এসব কোম্পানিকে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন দেয়? বিএসইসির উচিত বাজার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে যাচাই-বাছাই পূর্বক এদের আবেদন বাতিল করা। পাশাপাশি এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে বাজার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আইপিও কিংবা কিউআইও অনুমোদনের ব্যাপারে বিএসইসিকে আরও কঠোর হতে হবে বলেও তিনি মনে করছেন।
অন্য কোম্পানির নামে লিজের জমি কোটি টাকায় কেনা, জমি কেনার আগেই জমির উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয় ও রাতের আধারে প্রসপেক্টাসে জমির তথ্য বদলানোর গল্প নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন থাকছে আগামী পর্বে। (চলবে…)
Facebook Comments Box

Posted ১২:৪৯ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট ২০২৩

sharebazar24 |

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১২১৩১৪১৫১৬১৭১৮
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭২৮২৯৩০৩১  
মো. সিরাজুল ইসলাম সম্পাদক
মো. মহসিন হোসেন উপদেষ্টা সম্পাদক
বার্তা ও সম্পাদকীয় কার্যালয়

৬০/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০

হেল্প লাইনঃ 01742-768172

E-mail: [email protected]